সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

Featured Post

পোস্টমাস্টার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (গল্পগুচ্ছ)

পোস্টমাস্টার  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (গল্পগুচ্ছ)  প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারকে আসিতে হয়। গ্রামটি অতি সামান্য। নিকটে একটি নীলকুঠি আছে, তাই কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নূতন পোস্টআপিস স্থাপন করাইয়াছে।

অনুপমার প্রেম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। (পঞ্চম পরিচ্ছেদ)

অনুপমার প্রেম
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 
(পঞ্চম পরিচ্ছেদ) 
চন্দ্রবাবুর সংসার

 তিন বৎসর পরে খালাস হইয়াও ললিতমোহন বাড়ি ফিরিল না। কেহ বলিল, লজ্জায় আসিতেছে না। কেহ বলিল, সে গ্রামে কি আর মুখ দেখাতে পারে? ললিতমোহন নানা স্থান পরিভ্রমন করিয়া দুই বৎসর পরে সহসা একদিন বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার জননী আনন্দে পুত্রের শিরশ্চুম্বন করিয়া আর্শীবাদ করিলেন—“বাবা, এবার বিবাহ করে সংসারী হও, যা কপালে ছিল তা ত ঘটে গিয়েছে, এখন সেজন্য আর মনে দুঃখ ক’রো না।” ললিতও যাহা হয় একটা করিবে স্থির করিল।

 পাঁচ বৎসর পরে ফিরিয়া আসিয়া ললিত গ্রামে অনেক পরিবর্তন দেখিল, বিশেষ দেখিল, জগবন্ধুবাবুর বাটীতে। কর্তা-গিন্নী কেহ জীবিত নাই। চন্দ্রনাথবাবু এখন সংসার কর্তা, অনুপমা বিধবা হইয়া এইখানেই আছে, কারণ তাহার অন্যত্র স্থান নাই। পূর্বেই জননীর মৃত্যু হইয়াছিল, পরে পিতার মৃত্যুর পর অনুপমা ভাবিয়াছিল, পিতা যাহা দিয়া গিয়াছেন, তাহা লইয়া কোনও তীর্থস্থানে থাকিবে এবং সেই টাকায় পুণ্যধর্ম, নিয়মব্রত করিয়া অবশিষ্ট জীবনটা কাটাইয়া দিবে। কিন্তু শ্রাদ্ধশান্তি হইলে উইল দেখিয়া সে মর্মাহত হইল, পিতা কেবল তাহার নামে পাঁচ শত টাকা দিয়া গিয়াছেন। তাহারা বড়লোক, এ সামান্য টাকা তাহাদিগের নিকট টাকাই নহে; বাস্তবিক, এই অর্থে কাহারও চিরজীবন গ্রাসাচ্ছাদন নির্বাহিত হইতে পারে না। গ্রামে অনেকেই কানাঘুষা করিল, এ উইল জগবন্ধুবাবুর নহে, ভিতরে কিছু কারসাজি আছে। কিন্তু সে কথায় ফল কি, নিরুপায় হইয়া অনুপমা চন্দ্রবাবুর বাটিতেই রহিল।
 লোকে বলে, পিতার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সৎমাকে চিনতে পারা যায় না; সৎভাইকেও সেইরূপ পিতার জীবিতকাল পর্যন্ত চিনিতে পারা কঠিন। এতদিন পরে অনুপমা জানিতে পারিল, তাহার দাদা চন্দ্রনাথবাবু কি চরিত্রের মানুষ! যত প্রকার অধমশ্রেণীর মানুষ দেখিতে পাওয়া যায়, চন্দ্রনাথবাবু তাহাদের সর্বনিকৃষ্ট। হৃদয়ে একতিল দয়ামায়া নাই, চক্ষে একবিন্দু চামড়া পর্যন্ত নাই। অনুপমার এই নিরাশ্রয় অবস্থায় তিনি তাহার সহিত যেরূপ ব্যবহার আরম্ভ করিলেন, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। প্রতি কথায়, এমন কি উঠিতে বসিতে তিরস্কৃত, লাঞ্ছিত, অপমানিত করিতেন। অনেক দিন হইতে তিনি অনুপমাকে দেখিতে পারেন না, কিন্তু আজকাল ত অধিক না দেখিতে পারিবার কারণ তিনিই ভাল জানেন। বড়বধূ পূর্বে তাহাকে ভালবাসিতেন, কিন্তু এখন তিনিও দেখিতে পারেন না। যখন অনু বড়লোকের মেয়ে ছিল, যখন তাহার বাপ-মা বাঁচিয়াছিল, যখন তাহার একটা কথায় পাঁচজন ছুটিয়া আসিত, তখন তিনিও ভালবাসিতেন। এখন সে দুঃখিনী, আপনার বলিতে কেহ নাই, টাকাকড়ি নাই, পরের অন্ন না খাইলে দিন কাটে না, তাহাকে কে এখন ভালবাসিবে? কে এখন যত্ন করিবে? বড়বধূর তিন-চারিটি ছেলেমেয়ের ভার অনুর উপর; তাহাদিগকে খাওয়াইতে হয়, স্নান করাইতে হয়, পরাইতে হয়, কাছে করিয়া শুইতে হয়, তথাপি কোনও বিষয়ে একটু ত্রুটি হইলেই অমনি বড়বধূঠাকুরানী রাগ করিয়া রীতিমত পাঁচটা কথা শুনাইয়া দেন।
 ইহা ভিন্ন অনুপমাকে নিত্য দু'বেলা চন্দ্রবাবুর জন্য দুই-চারিটা ভাল তরকারি বাঁধিতে হয়; পাচক ব্রাম্মণ তেমন প্রস্তুত করিতে পারে না। আর না হইলে চন্দবাবুরও কিছু খাওয়া হয় না। একাদশীই হোক, আর দ্বাদশীই হোক, আর উপবাসই হোক, সে রান্না তাহাকে রাঁধিতেই হইবে। বিধবা হইয়া অনুপমা প্রাতঃকালে স্নান করিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া পূজা করিত; এখন তাহাকে সে সময়টুকুও দেওয়া হয় না। একটু বিলম্ব হইলেই বড়বধুঠাকুরানী বলিয়া উঠেন, “ঠাকুরঝি, একটু হাত চালিয়ে নাও, ছেলের কাঁদছে—এখন পর্যন্ত কিছু খেতে পায়নি।” অনুপমা যা-তা করিয়া উঠিয়া আসে, একটি কথাও সে মুখ ফুটিয়া বলিতে পারে না। একাদশীর দীর্ঘ উপবাস করিয়াও তাহাকে রাত্রে রন্ধন করিতে যাইতে হয়; তৃষ্ণায় বুক ফাটিতে থাকে, অগ্নির উত্তাপে মাথা টিপটিপ করিতে থাকে, গা ঝিমঝিম করে, তবু কথা কহে না। অবস্থার পরিবর্তনে সহ্য করিবার ক্ষমতাও হয়। কেননা, জগদীশ্বর তাহা শিখাইয়া দেন—না হইলে অনুপমা এতদিন মরিয়া যাইত।
 এ সংসারে তাহার অপেক্ষা দাসদাসীরা শ্রেষ্ঠ; জোর করিয়া তাহাদের দুটো বলিলে তাহারাও দুটো জোরের কথা বলিতে পারে, অন্ততঃ আমার মাহিনাপত্র চুকাইয়া দিন, বাড়ি যাই—এ কথাও বলিতে পারে, কিন্তু অনু তাহাও বলিতে না। সে বিনামূল্যে ক্রীতদাসী, মারো, কাটো, তাহাকে এখানে থাকিতেই হইবে। আর কোথাও যাইবার জো নাই, সে বিধবা, সে বড়লোকের কন্যা। অনুপমার অবস্থা বুঝাইতে পারা যায় না, বুঝিতে হয়; বাঙালীর ঘরে পরান্নপ্রত্যাশিনী বিধবাই কেবল তাহার অবস্থা বুঝিতে পারিবেন, অন্যে না বুঝিতেই পারে।
 আজ দ্বাদশী। সকাল সকাল স্নান করিয়া অনুপমা পূজা করিতে বসিল। তখনও পনর মিনিট হয় নাই; বড়বধু ঘরের বাহির হইতেই একটু বড় গলায় বলিলেন, “ঠাকুরঝি, তোমার কি আজ সমস্তদিনে হবে না? এমন করে চলবে না বাপু।” অনুপমা শিবের মাথায় জল দিতেছেল, কথা কহিল না; বড়বধু দশমিনিট পরে পুনর্বার ঘুরিয়া আসিয়া সেইখান হইতেই চিৎকার করিলেন—“অত পুণ্যি ছালায় আঁট্‌বে না গো, অত পুণ্যি ক’রো না—আর অত পুণ্যি-ধর্মের শখ থাকে ত বনে-জঙ্গলে গিয়ে কর গে, সংসারে থেকে অত বাড়াবাড়ি সইতে পারা যায় না।”
 তথাপি অনুপমা কথা কহিল না।
 বড়বৌ দ্বিগুণ চেঁচাইয়া উঠিলেন—“বলি, কেউ খাবে-দাবে না—না?”
 অনুপমা হস্তস্থিত বিল্বপত্র নামাইয়া রাখিয়া বলিল, “আমার অসুখ হয়েছে, আজ আমি কিছু পারব না।”
 “পারবে না? তবে সবাই উপোস করুক?”
 “কেন, আমি ছাড়া কি লোক নেই? ঠাকুরের কি হ'ল?”
 “তার জ্বর হয়েচে—আর উনি ঠাকুরের রান্না খেতে পারেন?”
 “না পারেন—তুমি রেঁধে দাও গে।”
 “আমি রাঁধব? মাথার যন্ত্রণায় প্রাণ যায়, একটা কবিরাজ চব্বিশ ঘন্টা আমার পিছনে লেগে আছে—আর আমি আগুনের তাতে যাব?”
 অনুপমা জ্বলিয়া উঠিল। বলিল, “তবে সবাইকে উপোস করতে বল গে।”
 “তাই যাই—তোমার দাদাকে এ কথা জানাই গে। আর তোমার অসুখ হবে কেন? এই নেয়ে-ধুয়ে এলে, এখনি গিলবে কুটবে, আর বড়ভাইকে একটু রেঁধে খাওয়াতে পার না?”
 “না, পারিনে। বড়বৌ, আমি তোমাদের কেনা বাঁদী নই যে, যা মুখে আসবে তাই বলবে। আমি এ-সব কথা দাদাকে জানাব।”
 বড়বৌ মুখভঙ্গী করিয়া বলিল, “তাই জানাও গে—তোমার দাদা এসে আমার মাথাটা কেটে নিয়ে যাক!”
 অনুপমা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল; তাহার পর বলিল, “তা জানি, দাদা ভাল হলে আর তোমার এত সাহস!”
 “কেন, তিনি করেছেন কি? খেতে দিচ্ছেন, পরতে দিচ্ছেন—আবার কি করবেন! সত্যি সত্যি ত আর আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে তোমায় মাথায় করে রাখতে পারেন না—এজন্য আর মিছে রাগ করলে চলবে কেন?”
 সমস্ত বস্তুরই সীমা আছে। অনুপমার সহিষ্ণুতারও সীমা আছে।
 সে এতদিন যাহা বলে নাই, আজ তাহা বলিয়া ফেলিল; বলিল, “দাদা আমাকে খাওয়াবেন পরাবেন কি—যে বাপের টাকায় তিনি খান—আমি সেই বাপের টাকায় খাই।”
 বড়বৌ ক্রুদ্ধ হইল—“তাই যদি হত, তা হলে বাপ আর পথের কাঙাল করে রেখে যেত না।”
 “পথের কাঙাল তিনি করে যাননি, তোমরাই করেছ। গ্রামসুদ্ধ সবাই জানে, তিনি আমাকে নিঃসম্বল রেখে যাননি। সে টাকা দাদা চুরি না করলে আজ আমাকে তোমার মুখনাড়া খেতে হ’তো না।”
 বড়বধূর মুখ প্রথমে শুকাইয়া গেল, কিন্তু পরক্ষণেই দ্বিগুণ তেজে জ্বলিয়া উঠিল—“গ্রামসুদ্ধ সবাই জানে—উনি চোর? তবে এ কথা ওঁকে জানাব?”
 “জানিও—আরও ব’লো যে, পাপের ফল তাঁকে পেতেই হবে।”
 সেদিন এমনই গেল। অবশ্য এ কথা চন্দ্রবাবু শুনিতে পাইলেন; কিন্তু কোনরূপ উচ্চবাচ্য করিলেন না।
 চন্দ্রনাথবাবুর সংসারে ভোলা বলিয়া একজন ছোঁড়া মত ভৃত্য ছিল। পাঁচ-ছয় দিন পরে চন্দ্রবাবু একদিন তাহাকে বাটীর ভিতর ডাকিয়া আনিয়া বেদম প্রহার করিতে লাগিলেন। চিৎকার-শব্দে অন্যান্য দাসদাসীরা ছুটিয়া আসিল—তখনও অসম্ভব মার চলিতেছে। অনুপমা ঘরের ভিতর পূজা করিতেছিল, পূজা ফেলিয়া সে-ও ছুটিয়া আসিল। ভোলার নাক-মুখ দিয়া তখনও রক্ত ছুটিতেছিল। অনুপমা চিৎকার করিয়া উঠিল, “দাদা কর কি—মরে গেল যে!”
 চন্দ্রবাবু খিঁচাইয়া উঠিলেন—“আজ বেটাকে একেবারে মেরে ফেলব। তোকেও সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলতাম, কিন্তু শুধু মেয়েমানুষ বলে তুই বেঁচে গেলি। আমার সংসারে এত পাপ আমি বরদাস্ত করব না। বাবা তোকে পাঁচ শ' টাকা দিয়ে গেছেন—তাই নিয়ে তুই আজই আমার বাড়ি থেকে দূর হয়ে যা।”
 অনুপমা কিছুই বুঝিতে পারিল না, “শুধু বলিল, সে কি?”
 “কিছুই নয়। আজ টাকা নাও, নিয়ে ভোলার সঙ্গে দূর হয়ে যাও। বাইরে গিয়ে যা খুশি কর গে।”
 অনুপমা সেইখানেই মূর্ছিত হইয়া গেল। দাসদাসীরা সকলেই এ কথা শুনিল। কেউ মুখে কাপড় দিয়া হাসিল, কেহ হাসি চাপিয়া ভাল মানুষের মত সরিয়া গেল, কেহ বা ছুটিয়া অনুপমাকে তুলিতে আসিল। চন্দ্রবাবু মৃতপ্রায় ভোলার মুখে আর একটা পদাঘাত করিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ